ডায়েট ও তার প্রচলিত ভুলধারণা; পর্ব ১ ।
ঋদ্ধি মুখার্জি(চ্যাটার্জি)
আজকাল “ডায়েট” শব্দটির সাথে মোটামুটি সকলেই পরিচিত। কিন্তু এই শব্দটি নিয়ে বহু ভুল ধারণার প্রচলন রয়েছে। যেকোনো সাধারণ মানুষের কাছে “ডায়েট” কথার অর্থ হল কম খাওয়া, শুধু ফল আর সব্জি খেয়ে থাকা, প্রায় কিছুই না খেয়ে থাকা,ভাত/রুটি না খেয়ে শুধু সবুজ সাক সব্জি খেয়ে থাকা ইত্যাদি. এই সমস্ত ধারণাই সম্পূর্ণ ভুল।
একটি সঠিক ডায়েট থেরাপির জন্য সমস্ত রকমের খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা আছে। একটি বাড়ি তৈরি করতে যেমন ইট, বালি , সিমেন্ট লাগে, ঠিক তেমনি শরীর কে সুস্থ রাখতে প্রত্যেকটি খাদ্যের প্রয়োজন রয়েছে।
আসুন আমরা কিছু ডায়েট সম্পর্কিত কিছু প্রচলিত ভুল ধারনার সঠিক উত্তর আজ আমরা জেনেনিঃ
১) “লো কার্ব”/ “নো কার্ব“ ডায়েট এই শব্দটির সাথে অল্প বিস্তর আমরা সকলেই পরিচিত। এই কথাটির সাধারণ মানে হল, রোজকার খাবারে ভাত, রুটি, সুজি, আলু, ওটস, চিড়ে, মুড়ি ইত্যাদি না রাখা বা কম পরিমানে রাখা। আমাদের প্রতিদিনের শরীরের প্রয়োজনীয় শক্তি তৈরি করতে যে খাদ্যের প্রয়োজন হয় তার প্রায় ৬০% আসে কার্বহাইড্রেট বা শর্করা জাতীয় খাদ্য থেকে, প্রায় ২০-২৫% আসে প্রোটিন বা আমিষ জাতীয় খাদ্য থেকে ও প্রায় ২০% ফ্যাট বা স্নেহ পদার্থ জাতীয় খাদ্য থেকে। সুতরাং বুঝতেই পারছেন ভাত, রুটি প্রয়োজনীয় পরিমাণে ডায়েটে রাখুন।
তবে সিম্পল কার্বহাইড্রেট যেমন- ভাত, আলু, মুড়ি ইত্যাদি এর বদলে কমপ্লেক্স কার্বহাইড্রেট, যেমন- আটার রুটি, ওট, দালিয়া, সুজি, বাজরা, রাগী ইত্যাদি খাওয়া বেশি ভালো, কারণ এতে প্রচুর পরিমাণে ডাইটারি ফাইবার থাকে যা পেট পরিস্কার রাখে ও শরীরের জল ধারনের ক্ষমতা বাড়ায়ে।
আর আরেকটি বিষয় আপনাদের জানিয়ে রাখা দরকার, যে , কার্বহাইড্রেট বাদ দিয়ে বাকি যে সমস্ত খাদ্য আমরা খাই যেমন- প্রোটিন জাতীয় খাবার, ফল ইত্যাদি, এই সমস্ত কিছুতেই অল্পবিস্তর কার্বহাইড্রেট থাকে, সুতরাং জিরো কার্বহাইড্রেট ডায়েট বলে কিছু হয় না।
২) “ফ্যাট” এই আরেকটি বিষয়,যা নিয়ে প্রচুর ভুল ধারনা ও মতভেদ রয়েছে। তবে WHO এর গাইডলাইন অনুযায়ী, মোট শক্তির ৩০% বা তারও কম আসা উচিৎ ফ্যাট থেকে। তবে এই ৩০% বা তার কম ফ্যাট এর উৎস আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট যেমন- তৈলাক্ত মাছ, বাদাম (আমন্ড,চীনেবাদাম ইত্যাদি), সূর্যমুখীর তেল, সর্ষের তেল, ক্যানোলা তেল, আভকাডো ইত্যাদি থেকেই আসা ভাল, এবং অবশ্যই নির্দিষ্ট পরিমাণে, সারাদিনে ২০-২৫ মি.লি। তবে যদি ঘরে তৈরি করা ঘি হয়, তাহলে সেটা ১ চা চামচ (৫ মি.লি) রাখা ভাল, তবে যদি কোন শারীরিক অসুস্থতা থাকে, ডাক্তার/ডায়েটিশিয়ান এর পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক।
৩) আমার কাছে আসা অনেক রোগীরা আমায় প্রশ্ন করে যে, মিষ্টি/চিনি খেতে বারণ করা হয় তাহলে অনেক ফলই তো মিষ্টি সেটা কেন খেতে বারন করা হয় না?
ফলে প্রধানত দুই ধরনের কার্বহাইড্রেট থাকে, গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজ । এই দুই এর পরিমাপ বিভিন্ন ফলে বিভিন্ন রকম হয়, তবে বেশির ভাগ ফলেই এই দুই এর পরিমাপ সমান – সমান হয়। গ্লুকোজ রক্তে সরাসরি সুগার এর মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, তবে ফ্রুক্টোজ রক্তে সরাসরি সুগারের মাত্রা বাড়ায় না। সুতরাং, বোঝাই যাচ্ছে ফলের মিষ্টি কোন ভাবেই ক্ষতিকারক নয় । ডায়াবেটিস রোগীদের ডায়েট-এ ফল একটি গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে। তবে প্যাকেটের কাটা বা প্রিজার্ভ করা ফল, বাজারে কিনতে পাওয়া ফলের রসের বদলে, প্রত্যেক দিন ১-২ টি গোটা ফল খাওয়ার তালিকায় রাখা বেশি উপকারী।
৪) যে কোন ডিটক্স ওয়াটার যেমন- উস্ন গরম জলে লেবু ও মধু / উস্ন গরম জলে শুধু মধু/গ্রীন টি ও মধু ইত্যাদি কিন্তু কোন ভাবেই ওজন কমায়না। যে কোন ডিটক্স ওয়াটার আপনার ডাইজেস্টিভ সিস্টেম ও মেটাবোলিজম কে সক্রিয় রাখতে সাহাজ্য করে। সঠিক ডায়েট প্ল্যানিং ও প্রত্যেকদিন এক্সারসাইজ করার সাথে সাথে যদি যে কোন ধরনের ডিটক্স ওয়াটার নেওয়া জায়, তাহলে সেটা আপনার ওজন কমাতে বা মেইনটেইন করতে সাহায্য করে।সুতরাং, অনেক দিন ধরে সকালে খালি পেটে উস্ন গরম জল আর লেবু খেয়েও কেন রোগা হচ্ছিনা, আশা করি বোঝা গেল।
৫) বাজার চলতি বিভিন্ন খাদ্য দ্রব্যের বিজ্ঞাপনে দেখা যায় যে, সকালে ব্রেকফাস্টে ও ডিনারে ১ বাটি ওটস বা কর্নফ্লেক্স খেয়ে রোগা হয়ে যাওয়া যায়। না সেটা কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। কোন একটি খাদ্য দ্রব্য আপনাকে রোগা , মোটা, সুস্থ কোনটাই করতে পারবেনা। ডায়েট একটি প্রসেস, যেটির সবকটি ধাপ আপনা কে ফলো করতে হবে। সুতরাং এই দামী, প্রিজারভেটিভ যুক্ত খাবার না খেয়ে, বাড়িতে তৈরি সহজলভ্য খাবার খেয়ে সুস্থ থাকাটাই শ্রেয়। আর যদি সত্যি সুস্থ থাকতে চান বা ডায়েট প্ল্যানিং এর প্রয়োজন হয়, এই বিজ্ঞাপণ ও ইউটিউব দেখে ডায়েট না করে একজন প্র্যাক্টিশিনার ডায়েটিশিয়ানের সাথে ডায়েট কাউনশিলিং করে নিজেকে ফিট রাখুন।
অবশ্যই যাচাই করে নেবেন যেন কোন ডিগ্রী কোর্স করা ডায়েটিশিয়ান হয়।
Wow