বুলেটিন্স ইন্ডিয়া ডেস্ক : সামনেই কালী পুজো। দুর্গা পুজোর পর বাঙালির অন্যতম প্রধান উৎসব। উৎসব মানেই সম্প্রীতির আনন্দঘন মুহূর্ত, হৈ-হুল্লোড় ইত্যাদি, কিন্তু কালিপুজো কথাটা শুনলেই সবার প্রথম আপনার মাথায় ঠিক কী কী বিষয় আসে? হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন, দীপাবলী মানেই আলোর জমকালো রোশনাই এবং অবশ্যই বাজি ফাটানো। যেমন চিনি ছাড়া চা বিস্বাদ, তেমনি বাজি ছাড়াও দীপাবলি অনর্থক।
যদিওবা সরকারি ভাবে বেশি আওয়াজ যুক্ত শব্দবাজি বর্তমানে নিষিদ্ধ, তবুও রঙমশাল ফুলঝুরি, ইত্যাদি জ্বালিয়েই আলোর উৎসব পালন করে থাকেন দেশবাসী।
কিন্তু শব্দবাজির কথা যখন উঠলই তখন ‘বুড়িমা’র বিখ্যাত চকলেট বোমার কথা না বললে সবটাই বৃথা।
‘বুড়িমার চকলেট বোমা’- নামটার সঙ্গে কেমন ওতপ্রোতভাবে জড়িত রয়েছে বাঙালীর ছোটবেলা। সে কালীপুজো হোক বা নতুন বছরের আগমন, বিয়ের অনুষ্ঠান হোক বা ভারতের বিশ্বকাপ জেতার আনন্দ সবেতেই বুড়িমা’র স্পেশাল ‘চকলেট বোমা’ থাকবেই। তবে আজ জানাবো প্যাকেটের ছবিতে থাকা সেই থুর-থুরে বুড়িমা’র ব্যাপারে, যাঁর আসল নাম অন্নপূর্ণা দাস।
সময়টা ছিল ১৯৪৮, দেশভাগে বিধ্বস্ত পূর্ব পাকিস্তান। তখন কঠিন রোগে ভুগছেন স্বামী সুরেন্দ্রনাথ। সঠিক চিকিৎসার অভাবে বাঁচানো যায়নি তাঁকে। সেখান থেকেই শুরু একজন মা তথা এক জন সামান্য নারীর অসামান্য বিধ্বংসী লড়াই।
অন্নপূর্ণা দাস সত্যিই সাক্ষাৎ মা অন্নপূর্ণা। বেঁচে থাকার তাগিদ এবং সন্তানদের মানুষ করার অভিপ্সা নিয়ে শুরু করলেন মহাসংগ্রাম। দুই ছেলে মেয়েকে নিয়ে পাড়ি দিলেন ভারতের উদ্দেশ্যে। গঙ্গারামপুরের রিফিউজি ক্যাম্পে কোনওরকমে পেলেন ঠাঁই। সেখানেই সবজি বিক্রি করে ছেলে মেয়ের জন্য অন্নসংস্থান করতে লাগলেন অন্নপূর্ণা।
এরপর গঙ্গারামপুরে বিড়ি বানানো শিখে বিড়ির ব্যবসা ধরলেন তিনি। একটু একটু করে নিজেদের গুছিয়ে নিলেন অন্নপূর্ণা। মেয়ের বিয়ে দিলেন বেলুড়ে। সেখানেই ন’শো টাকায় একটা দোকান কিনে নতুন জীবনে পা দিলেন তিনি।
দুর্গম পরিস্থিতি! সহজ ছিল না কোনও কিছুই। কিন্তু হাজারও বাধা-বিপত্তিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দাঁত চেপে লড়াই করে গেছেন এই নারী। সরস্বতী পুজোর সময় মূর্তি বিক্রি করা থেকে দোলের রং বিক্রি করা ইত্যাদি কোনও কিছুই বাদ যায়নি। সবেতেই লাভ করলেন ভালো।
এরপর অদম্য ইচ্ছে শক্তির অধিকারী নারী অন্নপূর্ণা, অন্নপূর্ণা থেকে ‘বুড়িমা’ হয়ে উঠল অচিরেই। গল্পটা ভীষণ ইন্টারেস্টিং। একদিন দোকানে কিছু ছেলে এসে বলল, ‘বুড়িমা লজেন্স দাও!’ ‘বুড়িমা’ ডাকটা কেমন কানে বাজল তাঁর! আয়না সামনে ধরতেই দেখলেন চুলে পাক ও চেহারায় বয়সের ছাপ পড়েছে। তারপর কিভাবে যেন ডাকটা ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে!
কালী পুজোর সময় বুড়িমা ধার করা টাকা থেকে দোকানে বাজি তুললেন। কিন্তু ছিল না কোনও লাইসেন্স পত্র। পুলিশ এসে বাজেয়াপ্ত করল সব বাজি, দোকান ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হল। অমনি জেদ ধরলেন ব্যবসা করলে বাজির ব্যবসাই করবেন।
যেমনি বলা তেমনি কাজ! জোগাড় করে ফেললেন বাজি বিক্রির লাইসেন্স পত্র। বাঁকড়ার আকবর আলীর কাছ থেকে রপ্ত করে নিলেন বাজি বানানোর কৌশল। সেই মত তৈরী করে ফেললেন বিখ্যাত ‘বুড়িমার চকলেট বোমা’।
ব্যাস অমনি বাজিমাত। ধীরে ধীরে ‘বুড়িমার চকলেট বোমা’ জায়গা করে নিল সর্বত্র। তাঁর নামের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর তৈরি বাজিও সকলের প্রিয় হয়ে উঠল। শুধু এখানেই থেমে থাকা নয়, তামিলনাড়ুর শিবকাশী নামক জায়গাতে দেশলাই কারখানা, রাজ্যের ডানকুনিতে বাজির কারখানা বানিয়ে অনেক নাম কামিয়েছেন আমাদের ‘বুড়ি মা’ অন্নপূর্ণা দেবী। তাঁর হাত ধরেই প্রথম বাজি বানানোর শিল্পে ওঠে তুমুল জোয়ার। এরপর তাঁর অবর্তমানে তাঁর ছেলে এবং নাতিরা সেই শূন্য থেকে থেকে শুরু করে তিলে তিলে গড়ে তোলা ব্যবসার দায়িত্ব নিয়েছেন।
তবে বর্তমানে ৯০ ডেসিবেলের বেশি শব্দযুক্ত বাজি সরকারিভাবে নিষিদ্ধ হওয়ায় বাতিল হয়েছে চকলেট বোমা। কিন্তু তাতে থমকে যায়নি ‘বুড়িমা’ ব্র্যান্ড। পরের প্রজন্মের হাত ধরেই বেশ রমরমিয়ে চলছে বুড়িমা’র বাজার। নানান রং-বেরঙের আতশবাজি তৈরি করে রীতিমতো তাকলা ব্র্যান্ড। সত্যি কুর্নিশে মনের বীরাঙ্গনাকে যিনি তাঁর বাজি দিয়ে বাজিমাত করেছেন সমস্ত বাধা প্রতিকূলতাকে জিতে নিয়েছেন মানুষের মন ও জীবনকে। আসলে আগুনের শেষ শিখাটাও নিভে যাওয়ার আগে দপদপিয়ে জ্বলে ওঠে অনেকখানি তেজ নিয়ে। সেই তেজেরই অন্য এক নাম অন্নপূর্ণা তথা ‘বুড়িমা’।
নুঙ্গির জঙ্গিদের জিনিস কিনে জামাতের ফান্ডে পরোক্ষভাবে অনুদান না দিয়ে ঊদ্বাস্তু হিন্দু পরিবারের উদ্যোগপতি বুড়িমা ব্র্যাণ্ডের বাজি কিনুন।